নাচতে নাচতে যখন মৃত্যু গ্রাস করল এক শহর

১৫১৮ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরে ঘটে এক অভিশপ্ত নৃত্য মহামারী। শত শত মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় নাচতে শুরু করে, কেউ ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়, কেউ মৃত্যুবরণ করে। ইতিহাসে “Dancing Plague of 1518” নামে পরিচিত এই ঘটনা নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে

নাচতে নাচতে যখন মৃত্যু গ্রাস করল এক শহর
Dancing Plague of 1518

মানব ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো বিজ্ঞানের অগ্রগতি, চিকিৎসা কিংবা সামাজিক বিশ্লেষণ দিয়েও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ও রহস্যময় ঘটনা হলো ১৫১৮ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরে ঘটে যাওয়া নৃত্য মহামারী। কয়েকশ মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন নেচেছে, অথচ তারা চাইলেও থামতে পারেনি। এই অস্বাভাবিক উন্মাদনা শেষ পর্যন্ত বহু মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজও ইতিহাসবিদরা একে “Dancing Plague of 1518” নামেই স্মরণ করেন।

ঘটনার শুরুটা হয় হঠাৎ করেই। ফ্রাউ ট্রোফিয়া নামের এক নারী রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেন। কোনো সঙ্গীত ছিল না, কোনো উৎসবও চলছিল না। তিনি একা নাচছিলেন, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রথম দিন কয়েক ঘণ্টা ধরে নাচার পরও তিনি থামলেন না। দ্বিতীয় দিনও তিনি একইভাবে নাচলেন। আশেপাশের মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, কিন্তু শিগগিরই তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গে যোগ দিল। এক সপ্তাহের মধ্যেই ডজনখানেক মানুষ রাস্তায় নেচে চলল, আর এক মাসের মধ্যে সেই সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে গেল।

এরা কেউ আনন্দের নাচ করছিল না। এটি ছিল যন্ত্রণাদায়ক, ক্লান্তিকর এবং নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক খিঁচুনির মতো এক নৃত্য। অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই শরীর ভেঙে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়াত এবং নাচতে থাকত। শহরের রাস্তাঘাটে, বাজারে, এমনকি গির্জার আশেপাশেও মানুষ নাচতে শুরু করেছিল। তাদের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্ক, শরীরে ছিল অবসাদ। অনেকে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে জ্ঞান হারাত, কারও হাড় ভেঙে যেত, এমনকি মৃত্যুও ঘটত।

ইতিহাসবিদরা এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো এটি ছিল এরগট নামক ফাঙ্গাসের বিষক্রিয়ার ফল। রাই নামের শস্যে জন্মানো এই ফাঙ্গাসে থাকে এরগট অ্যালকালয়েডস, যা LSD-এর মতো হ্যালুসিনেশন তৈরি করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি তখন অদ্ভুত বিভ্রমে ভোগে এবং শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়ে ওঠে। ফলে মানুষ নাচতে বা খিঁচুনির মতো নড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, এরগট বিষক্রিয়ায় সাধারণত মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থির দাঁড়ানোও কষ্টকর হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচতে পারা এই ব্যাখ্যার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না।

অন্য এক ব্যাখ্যা হলো এটি ছিল একধরনের মানসিক মহামারী, যাকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে “mass psychogenic illness” বলা হয়। ১৫১৮ সালে স্ট্রাসবুর্গ ভয়ঙ্কর সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে ভুগছিল। দুর্ভিক্ষ, রোগ, দারিদ্র্য এবং ধর্মীয় কুসংস্কার মানুষকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছিল। এক নারী যখন নাচতে শুরু করলেন, তখন সেই দৃশ্য সমাজের বাকিদের মস্তিষ্কেও গভীর প্রভাব ফেলে। ধীরে ধীরে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করল যে তারা কোনো অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়েছে, আর মনের অচেতন স্তর থেকে শরীর প্রতিক্রিয়া করতে লাগল। মানসিক আতঙ্ক এমনভাবে শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় রূপ নিল যে শত শত মানুষ একসাথে উন্মত্তভাবে নাচতে লাগল।

আরেকটি ব্যাখ্যায় বলা হয়, এই মহামারী ছিল ধর্মীয় আতঙ্কের ফসল। মধ্যযুগে অনেক মানুষ বিশ্বাস করত সেন্ট ভিটাস নামের এক খ্রিস্টীয় সন্ত অভিশাপ দিতে পারেন। যারা এই অভিশাপে পড়ত, তারা বাধ্য হয়ে নাচত যতক্ষণ না শরীর ভেঙে পড়ত। তাই অনেক নাগরিক ভেবেছিল তাদের এই অদ্ভুত নৃত্য সেন্ট ভিটাসের অভিশাপের ফল। তারা গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করত এবং সন্তের মূর্তির সামনে মাথা নত করত মুক্তির আশায়। এই বিশ্বাস আবার নতুন করে আতঙ্ক ছড়ায়, ফলে আরও বেশি মানুষ নাচতে শুরু করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরেক অংশ মনে করে এটি ছিল স্নায়বিক রোগ বা এপিলেপসির এক বিশেষ রূপ। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়—একই সময়ে কয়েকশ মানুষ কীভাবে একই উপসর্গে আক্রান্ত হলো? এটাই এই তত্ত্বকে দুর্বল করে দেয়।

আধুনিক গবেষক জন ওয়ালার তার বিশ্লেষণে বলেছেন, নৃত্য মহামারী আসলে এক ধরনের “psychogenic movement disorder”—অর্থাৎ মানসিক চাপ থেকে উদ্ভূত শারীরিক প্রতিক্রিয়া। তার মতে, ধর্মীয় আতঙ্ক, দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং হতাশার মিশ্রণে মানুষ অবচেতনভাবে এমনভাবে প্রতিক্রিয়া করেছিল যে তারা নিয়ন্ত্রণহীন নৃত্যে ডুবে যায়। এটিকে এক ধরনের গণ-উন্মাদনা বলা যায়।

তবুও রহস্য পুরোপুরি দূর হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন হয়তো এরগট বিষক্রিয়া ও মানসিক মহামারী মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করেছিল। বিষক্রিয়া মানুষকে বিভ্রমে ফেলেছিল, আর মানসিক আতঙ্ক সেই বিভ্রমকে আরও উসকে দিয়েছিল। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক চাপ এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে একটি পুরো শহরই যেন এক অভিশপ্ত নৃত্যে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

আজও এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা অজানা রয়ে গেছে। প্রতিটি তত্ত্বই কিছুটা সত্যের আভাস দেয়, আবার কিছুটা প্রশ্নও রেখে যায়। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—১৫১৮ সালের জুলাই মাসে স্ট্রাসবুর্গের মানুষ এমন এক শক্তির কবলে পড়েছিল যা তাদের নিজের ইচ্ছার বাইরে ছিল। তারা নেচেছিল মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে, থামতে পারেনি, আর শেষ পর্যন্ত ইতিহাসে রেখে গেছে এক অদ্ভুত রহস্যময় অধ্যায়।

নৃত্য মহামারী তাই শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব, সমাজব্যবস্থা এবং বিশ্বাসের জটিল সম্পর্কের প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে মানুষের মন ও শরীর কখনো কখনো এমনভাবে প্রতিক্রিয়া করতে পারে, যা বিজ্ঞানের প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে। সেই রক্তাক্ত নৃত্যের পদচিহ্ন আজও ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে, এক ভয়ঙ্কর স্মারক হিসেবে—যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবজীবনে রহস্যের স্থান সবসময় অমোঘ এবং অমোচনীয়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0