প্রাণী ও পশুর মধ্যে পার্থক্য কি
প্রাণী ও পশুর মধ্যে পার্থক্য মূলত শব্দের পরিধি, ব্যবহার ও প্রেক্ষাপটে নিহিত। ‘প্রাণী’ বলতে বোঝায় সব জীবন্ত সত্তা যারা প্রাণ ধারণ করে, আর ‘পশু’ সাধারণত মানুষের কাছে পরিচিত বা গৃহপালিত বড় প্রাণীকে বোঝায়। সব পশুই প্রাণী হলেও সব প্রাণী পশু নয়। বৈজ্ঞানিক দিক, ভাষাগত ব্যবহার, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক অর্থ—সব মিলিয়ে এদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
 
                                    প্রাণী ও পশুর মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে এই দুটি শব্দের অর্থ, উৎপত্তি এবং ব্যবহার কেমনভাবে গড়ে উঠেছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক সময় প্রাণী ও পশু শব্দ দুটি একে অপরের পরিবর্তে ব্যবহার করি, কিন্তু ভাষাগত ও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য বোঝা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে এবং প্রাকৃতিক জীবজগতের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়।
বাংলা ভাষায় ‘প্রাণী’ শব্দটি এসেছে ‘প্রাণ’ থেকে, যার অর্থ জীবন বা জীবন্ত সত্তা। প্রাণী বলতে বোঝানো হয় সেইসব জীবকে যাদের মধ্যে প্রাণ আছে, যারা সচল, খাদ্য গ্রহণ করে, শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় এবং বংশবৃদ্ধি করে। প্রাণী শব্দটি অত্যন্ত বিস্তৃত এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এর অন্তর্ভুক্ত হলো সমুদ্রের ক্ষুদ্রতম প্ল্যাংকটন থেকে শুরু করে বিশালাকার হাতি, মানুষ এবং বিভিন্ন অদ্ভুত সামুদ্রিক জীব পর্যন্ত। প্রাণীর বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাসে ‘অ্যানিমেলিয়া’ রাজ্যের অন্তর্গত সমস্ত জীবকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি রয়েছে। অর্থাৎ, সব পশুই প্রাণী, কিন্তু সব প্রাণী পশু নয়।
অন্যদিকে ‘পশু’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পশু’ থেকে, যার অর্থ বাঁধা বা গৃহপালিত জন্তু। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে পশু বলতে বোঝানো হতো সেইসব জীবকে যাদের মানুষ খাদ্য, শ্রম বা অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহার করে। তাই পশুর সংজ্ঞায় সাধারণত গৃহপালিত স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, উট, মহিষ, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়। পশু শব্দটি অনেক সময় বন্যপ্রাণীকেও বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে শিকারযোগ্য বা মানুষের কাছে পরিচিত বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে। তবে শব্দটির মূল প্রেক্ষাপট গৃহপালন ও মানুষের প্রয়োজনের সাথে সম্পর্কিত।
পার্থক্য বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিধি ও উদ্দেশ্য। ‘প্রাণী’ একটি সর্বজনীন শব্দ যা জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণিজগতকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে কোনো প্রকারের গৃহপালন, বন্য বা উপকারী-অপকারী হিসেবে বিভাজন নেই। অন্যদিকে ‘পশু’ শব্দটি সাধারণত মানুষ কর্তৃক ব্যবহৃত বা পরিচিত, গৃহপালিত বা বড় আকারের প্রাণীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ফলে, মৌমাছি, প্রজাপতি, সিংহ, হাঙর—সবাই প্রাণী, কিন্তু তারা সবাই পশু নয়। মৌমাছি এবং প্রজাপতি কীটপতঙ্গ, তাই আমরা তাদের পশু বলি না। সিংহ ও হাঙর বন্য শিকারী প্রাণী, যারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গৃহপালিত ধারণার মধ্যে পড়ে না, যদিও কথোপকথনে কখনো কখনো তাদের পশু বলা হয়।
ভাষার ব্যবহারে এই পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়। বিজ্ঞানসম্মত প্রবন্ধে বা প্রাকৃতিক ইতিহাস আলোচনায় ‘প্রাণী’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়। যেমন, “পৃথিবীতে প্রাণীর বিবর্তন প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়েছে।” কিন্তু কৃষিজীবী সমাজে বা গ্রামীণ জীবনে মানুষ সাধারণত ‘পশু’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করে। যেমন, “গরু হলো মানুষের অন্যতম উপকারী পশু।” এখানে বোঝা যাচ্ছে যে শব্দ দুটি প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ব্যবহার হয় এবং শ্রোতার কাছে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দেয়।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্মে ‘পশুপতি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যা শিবের আরেকটি নাম এবং এর অর্থ পশুর প্রভু বা রক্ষক। এখানে পশু শব্দটি মূলত গৃহপালিত বা মানুষের সান্নিধ্যে থাকা প্রাণীদের বোঝায়। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মে ‘সত্ত্ব’ বা ‘প্রাণী’ শব্দটি ব্যবহার হয় সমস্ত জীবিত সত্তাকে বোঝাতে, যা কেবল প্রাণিজগত নয় বরং মানুষের জীবনকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
আধুনিক জীববিজ্ঞানে প্রাণী ও পশুর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রেণিবিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণীজগতের মধ্যে বহু অঙ্গরাজ্য, পর্ব, শ্রেণি, বর্গ, পরিবার, গণ এবং প্রজাতি রয়েছে। পশু সাধারণত এই বৃহৎ কাঠামোর মধ্যে সীমিত কয়েকটি শ্রেণি বা বর্গের অন্তর্গত, বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের। বিজ্ঞানীরা যখন প্রাণীর শারীরবৃত্তীয় গঠন, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন, তখন তারা সব ধরনের প্রাণীকেই বিবেচনা করেন। কিন্তু পশুবিজ্ঞান মূলত গৃহপালিত বা মানুষের উপকারী প্রাণীর প্রজনন, খাদ্য, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে।
আরও একটি সূক্ষ্ম বিষয় হলো আবেগ ও ধারণার পার্থক্য। ‘প্রাণী’ শব্দটি সাধারণত নিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। অন্যদিকে ‘পশু’ শব্দটির মধ্যে প্রায়ই মানবিক সম্পর্ক, ব্যবহারিকতা এবং কখনো কখনো অবজ্ঞার সুর থাকে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে অবমাননা করতে ‘পশু’ বলা হয়, কিন্তু ‘প্রাণী’ বলা হয় না। এই ব্যবহারিক পার্থক্য আমাদের ভাষার মনস্তাত্ত্বিক দিকও প্রকাশ করে।
প্রকৃতপক্ষে, সব পশুই প্রাণী কিন্তু সব প্রাণী পশু নয়—এটাই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং সঠিক সংজ্ঞা। প্রাণী শব্দটি আমাদের সমগ্র জীবজগতের এক বিশাল চিত্র তুলে ধরে, যা সমুদ্র, আকাশ ও স্থলভাগের সব জীবন্ত সত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। পশু শব্দটি সেই বৃহত্তর চিত্রের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু মানুষের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বোঝায়, যা মানুষের জীবনযাপন, অর্থনীতি, কৃষি এবং সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
সুতরাং বলা যায়, ‘প্রাণী’ হলো জীবনের একটি বৈজ্ঞানিক ও সর্বজনীন ধারণা, আর ‘পশু’ হলো মানুষের ব্যবহার ও সম্পর্কভিত্তিক একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ধারণা। ভাষা, প্রেক্ষাপট ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে আমরা এই পার্থক্য বুঝতে পারি এবং জীবজগতের বৈচিত্র্যকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। প্রাণী ও পশুর এই সূক্ষ্ম পার্থক্য শুধু ভাষাগত কৌতূহল নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং পরিবেশ সচেতনতার অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
What's Your Reaction?
 Like
        0
        Like
        0
     Dislike
        0
        Dislike
        0
     Love
        0
        Love
        0
     Funny
        0
        Funny
        0
     Angry
        0
        Angry
        0
     Sad
        0
        Sad
        0
     Wow
        0
        Wow
        0
     
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 
                                                                                                                                                     
                                                                                                                                                     
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                            