সবুজের নীচে নিঃশব্দ প্রার্থনা
সবুজের নীচে নিঃশব্দ প্রার্থনা” একটি কাব্যিক প্রবন্ধ যেখানে গ্রামীণ প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য, মাটির গন্ধ, ধানক্ষেতের দোলা, গাছের ছায়া ও নিস্তব্ধতার মাঝে লুকিয়ে থাকা জীবনের ছন্দ তুলে ধরা হয়েছে।
 
                                    ছায়াঘেরা এই ছবির নীচে যেন এক নিঃশব্দ কবিতা লুকিয়ে আছে মাটির গন্ধ, নরম রোদের আলো, আর দূরের সবুজের তরঙ্গায়িত স্বপ্ন। বড় গাছের শেকড়ের নিচে মাটি যেন দীর্ঘদিনের ক্লান্তি ভুলে বিশ্রাম নিচ্ছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে শিশিরভেজা ঘাসে, যেন প্রকৃতির অজানা কোনো বার্তা মাটিতে লিখে গেছে। মাঠের বুক জুড়ে ধান গাছের ঢেউ, বাতাস বয়ে যায়, দোল খায় একটুখানি, তারপর আবার স্থিরতা যেন নিঃশব্দে প্রার্থনা করছে পৃথিবী নিজেই।
এখানে সময় যেন ধীরে চলে। শহরের যান্ত্রিক শব্দ, তাড়াহুড়ো, কোলাহল সব যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। শুধু বাতাসের মৃদু সুর, গাছের পাতায় খেলা করা আলো-ছায়া, আর দূরের কয়েকটি গরুর শান্ত পদচারণা। জীবনের আসল সৌন্দর্য এখানে নিঃশব্দে প্রকাশ পায় বড় কিছু নয়, বরং ছোট ছোট জিনিসে, নিঃশব্দে। এই সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হয়, মানুষ আসলে প্রকৃতিরই এক টুকরো; সে যতই কংক্রিটের দেয়ালে নিজেকে বন্দি করুক, মাটির গন্ধই তার চূড়ান্ত আশ্রয়।
ছবির বাঁ দিকের বিশাল গাছটি যেন পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে এই মাঠ, এই আকাশ, এই বাতাসের নীরব সাক্ষী হয়ে। তার ছায়া যেন মাটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, যেন বলছে, “আমি আছি, ভয়ের কিছু নেই।” গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা যেন জীবনের প্রসারিত হাত, আর পাতার প্রতিটি নড়াচড়া যেন জীবনের স্পন্দন। এই গাছ কেবল একটি গাছ নয়, এটি সময়ের নিঃশব্দ ইতিহাস, যার পাতার নিচে হয়তো অনেক গল্প জন্ম নিয়েছে, অনেক মন কেঁদেছে, আবার হাসিও ছড়িয়েছে।
সবুজ ধানের ক্ষেত যেন এক জীবন্ত সাগর। প্রতিটি পাতার ডগা থেকে উঠে আসে এক অদৃশ্য সুর জীবনের গান, সংগ্রামের গান, আশার গান। কৃষকের হাতের ছোঁয়া লেগে এই ধানগাছগুলো যেন কথা বলে “আমরা তোমার অন্ন, তোমার জীবন, তোমার উৎসব।” দূরে কয়েকটি তালগাছ দিগন্তকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন গ্রামের চিরচেনা প্রতীক হয়ে মেঘলা দিনের ছায়া, কিংবা ঝড়ের সময় দৃঢ়তার প্রতীক। তাদের দেহে ধরা পড়ে বাংলার প্রাচীন মাধুর্য সরল অথচ অটল।
আকাশটাও আজ অদ্ভুত রকমের শান্ত। কিছু তুলোর মতো মেঘ ভাসছে, সূর্যের আলো একটু নরম, একটু কুণ্ঠিত, যেন প্রকৃতি নিজেই বিশ্রামে গেছে। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে দূরের কোনো গন্তব্যে, আবার ফিরে আসবে এটাই জীবনের চক্র। এ দৃশ্যের ভেতরে এক অদৃশ্য প্রশান্তি আছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; শুধু অনুভব করা যায় হৃদয়ের গভীরে।
যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনে, সে শুনতে পাবে বাতাসের নরম গুঞ্জন, পাতার দোলে দোলে ছন্দ, দূরের গরুর ঘণ্টাধ্বনি, আর মাটির নিচে ধীর শ্বাসের শব্দ। এই নিস্তব্ধতার মধ্যেও এক জীবন্ত স্পন্দন আছে যেন পৃথিবীর প্রতিটি কণিকা জীবনের আনন্দে ভরে আছে। মানুষ যখন ক্লান্ত হয়, ভীত হয়, কিংবা হারিয়ে যায় তখন এমন দৃশ্যই তাকে ফিরিয়ে আনে নিজের কাছে।
এই ছবিটা কোনো সাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; এটি এক আত্মার আয়না। এখানে শান্তি আছে, ধৈর্য আছে, ভালোবাসা আছে যা আজকের দ্রুতগতির পৃথিবীতে হারিয়ে গেছে। এখানে সময় থেমে থাকে, মানুষ থেমে নিজেকে খুঁজে পায়। হয়তো গাছটার নিচে বসে কেউ একসময় স্বপ্ন দেখেছিল, হয়তো কেউ কোনো প্রিয়জনকে চিঠি লিখেছিল, হয়তো কেউ স্রেফ আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের মানে খুঁজেছিল। এই গাছ, এই মাঠ, এই আকাশ সব একসাথে মিলে যেন বলে দেয়, “জীবন সুন্দর, যদি তুমি তাকে একটু সময় দাও।”
এ দৃশ্যের মধ্যে একটা চিরন্তন সত্য লুকিয়ে আছে প্রকৃতি কখনও তাড়াহুড়ো করে না, তবু সব কিছু ঘটে যায় তার নিজের সময়ে। পাতার জন্ম হয়, ফুল ফোটে, ধান পাকে, আবার ঝরে যায়; তবু প্রকৃতির চোখে কিছুই হারায় না, সব কিছুই ফিরে আসে অন্য রূপে। হয়তো মানুষও তাই হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসে, ভেঙে গিয়ে আবার গড়ে ওঠে।
এই ছবির প্রতিটি রঙ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি রেখা সব মিলিয়ে যেন বলে দেয় এক অনন্ত কবিতা:
“জীবন মানে শান্তি খোঁজা নয়, শান্তিকে নিজের ভেতরে জন্ম দেওয়া।”
এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, পৃথিবীর সব কোলাহল, সব ভয়, সব তৃষ্ণা মুছে গিয়ে শুধু শান্তির সুর বাজছে পাতার দোলায়, বাতাসের ছোঁয়ায়, মাটির সুবাসে, আর সেই নিরব আকাশের নিচে।
What's Your Reaction?
 Like
        0
        Like
        0
     Dislike
        0
        Dislike
        0
     Love
        0
        Love
        0
     Funny
        0
        Funny
        0
     Angry
        0
        Angry
        0
     Sad
        0
        Sad
        0
     Wow
        0
        Wow
        0
     
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 
                                                                                                                                                     
                                                                                                                                                     
                                                                                                                                                     
                                                                                                                                                     
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                            