গোলাপি চাঁদ কেন দেখা যায়

এপ্রিল মাসে যখন ক্রিপিং ফ্লক্স নামক গোলাপি ফুল প্রস্ফুটিত হয়, তখন এই পূর্ণিমাকে "পিংক মুন" বা গোলাপি চাঁদ বলা হতো

গোলাপি চাঁদ কেন দেখা যায়
গোলাপি চাঁদ

প্রতি বছর এপ্রিল মাসে, রাতের আকাশে এক বিশেষ ধরনের চাঁদ দেখা যায়, যা গোলাপি চাঁদ বা "পিংক মুন" নামে পরিচিত। এই নাম শুনে অনেকেই হয়তো ভাবেন যে চাঁদটি বুঝি সত্যিই গোলাপি রঙের হয়ে যায়। কিন্তু বিজ্ঞান এই ধারণাকে সমর্থন করে না। আসলে, এই নামকরণের পেছনের কারণটি যতটা না জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক। এই আর্টিকেলে আমরা গোলাপি চাঁদের নামকরণের পেছনের রহস্য উন্মোচন করব এবং বিজ্ঞান কী বলে, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব।

গোলাপি চাঁদের নামকরণের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতিতে। বিশেষ করে, অ্যালগনকুইন উপজাতির মানুষেরা এই নামকরণের জন্য পরিচিত। তাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের পূর্ণিমা এমন এক সময়ে আসে যখন বন্য ফুল, বিশেষ করে ফ্লক্স সাবুলটা (Phlox subulata) নামে এক ধরনের গোলাপি রঙের ফুল, যার আরেক নাম ক্রিপিং ফ্লক্স বা মস পিঙ্ক, বনাঞ্চলে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে। এই ফুলের সৌন্দর্যের কারণে তারা এপ্রিলের পূর্ণিমার নামকরণ করেন "পিংক মুন"।

এই নামকরণটি কোনো বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি, বরং প্রকৃতির একটি বিশেষ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। আদিবাসী আমেরিকানদের বিভিন্ন উপজাতি প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে চাঁদের নামকরণ করত। যেমন, গ্রীষ্মের সময় যখন স্ট্রবেরি ফল পাকত, তখন তারা পূর্ণিমার নাম দিত "স্ট্রবেরি মুন"। একইভাবে, যখন হান্টিং বা শিকারের মৌসুম শুরু হতো, তখন তারা পূর্ণিমার নাম দিত "হান্টার্স মুন" রাখত। সুতরাং, "গোলাপি চাঁদ" নামটি চাঁদের প্রকৃত রঙকে নির্দেশ করে না, বরং এটি একটি প্রাকৃতিক ঋতুচক্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বিজ্ঞানীরা বলেন, চাঁদ সাধারণত গোলাপি রঙের হয় না। চাঁদের রঙ নির্ভর করে সূর্যের আলোর ওপর, যা চাঁদ থেকে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসে। চাঁদের পৃষ্ঠে কোনো অভ্যন্তরীণ আলো নেই; এটি শুধুমাত্র সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। চাঁদের স্বাভাবিক রঙ ধূসর বা সাদাটে। তবে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে, চাঁদকে হালকা হলুদ, কমলা, বা এমনকি লালচে দেখাতে পারে।

Licensed by Google

চাঁদের রঙ পরিবর্তনের কারণ হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। যখন চাঁদ দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, তখন তার আলো বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের চোখে পৌঁছায়। এই দীর্ঘ পথের কারণে, বায়ুমণ্ডলের কণাগুলো স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলোকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়, কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল, কমলা এবং হলুদ আলোকে যেতে দেয়। তাই চাঁদকে তখন কমলা বা লালচে দেখায়। দিগন্ত থেকে যত উপরে ওঠে, বায়ুমণ্ডলের স্তর তত পাতলা হয়ে যায় এবং আলো কম বিক্ষিপ্ত হয়, ফলে চাঁদ তার স্বাভাবিক ধূসর বা সাদাটে রঙ ফিরে পায়। এই ঘটনাটিকে রেলি স্কেটারিং (Rayleigh scattering) বলা হয়, যা সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময় আকাশকে লাল দেখানোর জন্যও দায়ী।

গোলাপি চাঁদের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে। এপ্রিলের পূর্ণিমা যখন দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, তখন তাকে হালকা কমলা বা হলুদ দেখানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু এটি কখনই গোলাপি হয় না। তাই, "গোলাপি চাঁদ" নামটি একটি উপাধি মাত্র, কোনো বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা নয়।

গোলাপি চাঁদের মতো আরও অনেক পূর্ণিমার চাঁদ আছে, যাদের বিভিন্ন ধরনের নাম আছে। যেমন:

  • স্ট্রবেরি মুন: জুন মাসের পূর্ণিমা, যখন স্ট্রবেরি পাকার সময় হয়।

  • সুপারমুন: যখন পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সময় চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। এই সময় চাঁদকে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড় এবং উজ্জ্বল দেখায়।

  • হানি মুন: গ্রীষ্মের প্রথম পূর্ণিমা, যখন মধু সংগ্রহ করা হতো।

  • ব্লু মুন: এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় পূর্ণিমাকে ব্লু মুন বলা হয়, যা অত্যন্ত বিরল। এর সাথে চাঁদের রঙের কোনো সম্পর্ক নেই।

এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায় যে চাঁদের নামকরণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক, ঋতুভিত্তিক বা ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এই নামগুলো আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক গভীর ইতিহাস তুলে ধরে।

"গোলাপি চাঁদ" কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ঐতিহ্যবাহী নাম যা প্রকৃতির পরিবর্তনকে স্মরণ করে। এটি উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে এসেছে এবং এপ্রিল মাসের পূর্ণিমাকে চিহ্নিত করে, যখন ফ্লক্স সাবুলটা ফুল প্রস্ফুটিত হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে, চাঁদকে সাধারণত গোলাপি দেখায় না; তবে বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাবের কারণে এটিকে কখনও কখনও লাল, কমলা বা হলুদ দেখায়। তাই, যখন আপনি পরের বার গোলাপি চাঁদের কথা শুনবেন, তখন মনে রাখবেন যে এটি ফুলের সৌন্দর্যকে সম্মান জানানোর একটি সুন্দর উপায়, চাঁদের আসল রঙকে নির্দেশ করে না। এটি একটি চমৎকার উদাহরণ যা দেখায় যে কীভাবে বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0